আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়ায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা ও অস্বস্তি বিরাজ করছে। এই অবস্থায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে এবং আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। নিজেদের দাবির পক্ষে অবস্থান আরও জোরালো করতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের সঙ্গেও বৈঠক করবে বিএনপি।
বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো বলছে, এসব বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল নিজেদের মধ্যকার ঐকমত্য ধরে রেখে একই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখা। অর্থাৎ সরকার যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন ও সংস্কারের প্রশ্নে বিভক্তি-বিভাজন তৈরি করতে না পারে-সেটাই লক্ষ্য ছিল। একইসঙ্গে সরকারকে চাপে রাখা। যাতে সরকার ৪০-৫০ যে কয়টি রাজনৈতিক দলের কথা বলে, সবাই যেন বলে ডিসেম্বর মধ্যে নির্বাচন চাই।
বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে লিয়াঁজো কমিটি যুগপৎ আন্দোলনের সবকটি দল অর্থাৎ ২০টি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদ এবং আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। অন্যদিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বিএনপির আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে বলে বিএনপির একটি সূত্রে জানা গেছে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে দল-জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া দলগুলোর নেতারা বলছেন, বৈঠকে বিএনপি নেতারা তাদের বলেছেন, ২০১৮ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের সময় আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। এরপর আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নির্যাতনও ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছি। সেই ঐক্য এখনও অটুট রয়েছে। বিএনপি আশাবাদী যে, তাদের প্রতি মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সেই আস্থা আগামীতে বজায় থাকবে। উত্তরে মিত্র দলগুলোর নেতারা বলেছেন কাক্সিক্ষত সাফল্য না পাওয়া পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপির সঙ্গে থাকবে।
দলগুলোর নেতারা আরও বলছেন, বৈঠকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি তাদের এখনও আস্থা আছে এবং সেই আস্থাই তারা রাখতে চায়। তবে, সরকারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নানাবিধ চিন্তাভাবনা ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে কারও-কারও বক্তব্যে নানা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যও প্রকাশ পেয়েছে। এসব বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, বৈঠকে শরিক দলগুলোর প্রতি বিএনপির পরামর্শ ছিল কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পরিষ্কার না হয়ে আগেই মন্তব্য না করার। ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ সৃষ্টি করে এমন মন্তব্য থেকেও বিরত থাকতে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বৈঠকে সামগ্রিক ব্যাপারে কথা বলেছি আমরা। সরকার বা সরকারে যারা আছে, তাদের অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে, তড়িঘড়ি করে বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে যেতে চায়। এই অপ্রচার নিয়ে আমরা কথা বলেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই-আগস্ট বিচারের গতিকে ত্বরান্বিত ও দৃশ্যমান করতে চাই। আর সংস্কারের বিষয়টি তো আমাদের অনেক আগের কমিটমেন্ট।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করা ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, অতীতের ন্যায় আমরা আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধ থাকবো। যতদিন না কাক্সিক্ষত সাফল্য আসে, ততদিন ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপির পাশে থাকার বিষয়ে বৈঠকে একমত পোষণ করেছেন ১২ দলীয় জোটের নেতারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের একটি দলের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেসব বিষয়ে সবাই একমত, সেখানে সবাই সই (স্বাক্ষর) করে একটা সনদ স্বাক্ষরিত হবে। তারপর থাকে নির্বাচন। ফলে, সরকারের সদিচ্ছা কাজ করলে ডিসেম্বর বা তার আগেই নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সরকার বড় ইস্যু করে আনছে, আমরা পুরো পরিস্থিতি দেখছি। সরকারের মধ্যে নানা ধরনের চিন্তা ও তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা ও অস্বস্তি বিরাজ করছে বলে জানান বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, এনসিপিসহ অল্প কয়েকটি দল ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বারবার সরকারকে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা করেনি। যার ফলে, নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অপ্রয়োজনীয় দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যদিও এটা হওয়ার কথা ছিল না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়ায় নিশ্চয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনো পাত্তাই দেয় না। তাদের সেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নেই। তাদের প্রথম টার্গেট হচ্ছে, কীভাবে তাদের সরকারের স্থায়িত্ব বাড়ানো যেতে পারে, এই নিয়ে।
বর্তমান সরকারের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির এই নেতা বলেন, তারা সব শেষে যদি মানবিক করিডোর নিয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যার মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়ে যায়... এটার ম্যান্ডেট তো তাদের নেই। তারা যে যার মতো চলে যাবে দেশের মানুষকে এই যুদ্ধের অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে। আসলে তাদের কোনও জবাবদিহিতা নেই, দূরদর্শিতা নেই। তাদের অন্যতম চিন্তা হলো নিজস্ব ক্ষমতার স্থায়ীত্বকাল কীভাবে বাড়ানো যায়। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে আমার দল এই রকমই মনে করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১২ দলীয় জোটের একটি দলের শীর্ষ নেতা বলেন, বর্তমান সরকারের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকার কথা না, তারা কোনো দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও না। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানানোর দরকারও নেই তাদের। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা তাই-ই বানাচ্ছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এক ধরনের অস্বস্তি তো আছেই। সরকারের নানা পদক্ষেপে নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা কিংবা অনিশ্চিত সময়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা তৎপরতা আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* ঐক্য ধরে রাখতে ৫০টি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেছে দলটি * বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা ও অস্বস্তি
এবার পাল্লা ভারী করার মিশনে বিএনপি
- আপলোড সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৮:০৫:২৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৮:০৫:২৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ